বাংলাদেশে ঘুষ দুর্নীতি, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য, আলোচনা সমালোচনার শীর্ষে অবস্থান করছেন বর্তমান গাজীপুর জেলা রেজিস্টার সাবিকুন নাহার। যেখানেই পদায়ন হয়েছেন সেখানেই রেখেছেন অনিয়ম, দুর্নীতির স্বাক্ষর। দুর্নীতির দায়ে বরখাস্ত হয়েও দুর্নীতির মানস কন্যা ও অনিয়মের রাণী পুরস্কৃত হয়েছেন জেলা রেজিস্ট্রার হিসেবে।
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হয়েও ছিলেন আওয়ামী লীগের এক নিষ্ট কর্মী। যেখানেই পদায়ন হয়েছেন সেখানেই আওয়ামী লীগের বিভিন্ন কর্মসূচীর অর্থের যোগানদাতা হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। সে কারনেই আশ্বীর্বাদ পুষ্ট হয়েছেন সাবেক প্রশানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে সাবেক আইন মন্ত্রী সহ বিভিন্ন মন্ত্রী এমপি, আমলা, জেলা উপজেলা পর্যায়ে নেতাদের। স্বৈরাচার সরকার আমলে তাহার দুর্নীতির অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদকের অনুসন্ধানে সত্যতা উদঘাঠিত হলেও অদৃশ্য ইশারায় সেগুলো অদৃশ্যই থেকে যায়।
ঘুষ দুর্নীতি নিয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশ হলেও কোন কিছুই থামাতে পারেনি থাকে। সাব-রেজিস্ট্রার থাকাকালীন সময়ে প্রত্যেক অফিস পরিচালনা করতেন রাষ্ট্রীয় আইনেকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজ সৃষ্ট কমিশন আইন বাস্তবায়ন করে। জমির শ্রেণী পরিবর্তন, জাল দলিল সম্পাদন, সরকারি ফির অতিরিক্ত দলিল প্রতি লাখে ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা। দলিল লিখক সমিতির নামে দলিল প্রতি আটশত টাকা। দান/হেবা/ পাওয়ার অব অ্যাটর্নি/বন্টননামা দলিলে সরকারি ফি না থাকলেও দলিল প্রতি নিতেন পাঁচ থেকে পঞ্চাশ হাজার টাকা। কোন দলিল, পর্চা খারিজের মুলকপি, আয়কর রিটার্ন, আইডি কার্ডের সাথে নামে পার্থক্য (প্রত্যয়ন পত্র থাকলেও) থাকলে দলিল লিখকদের কে খাস কামড়ায় ডেকে অথবা অফিস সহকারি/পিয়নদের মাধ্যমে নিতেন পাঁচ থেকে দশ হাজার এবং সই মহরী নকল প্রতি নিতেন পাঁচশত টাকা।
অনিয়মের শীর্ষ চূড়ায় পৌছে জাল দলিল, ভূমির রকম পরিবর্তন দলিল সম্পাদনের কারণে ২০০৮ সালে দোহারে যৌথ বাহিনীর হাতে আটক হলেও তৎকালীন আইজিআর মজদার হোসেনের অনুরুধে ছাড়া পেয়ে সাময়িক বরখাস্ত হন। পরিকল্পিত ভাবে তার অপরাধের বোঝা মাথায় নিয়ে বিনাদোষে জেলে যেত হয় পিয়ন ও অফিস সহকারী কে। তদবির করে নারায়নগঞ্জের রুপগঞ্জ সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে বদলী হয়েও তিনি থেমে থাকেননি। ২০১৪ সালের তার অনিয়ম দুর্নীতি হাতেনাতে ধরে ফেলেন আইন ও বিচার বিভাগের সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হক। অবৈধভাবে ৪০৫২, ৪৫২৭ নং দলিল সম্পাদনের কারণে সরকার বিপুল পরিমাণ রাজস্ব হারায়। সে ঘটনায় আবার সাময়িক বরখাস্ত হন।
পরবর্তীতে গুলশান সাব-রেজিস্ট্রার হিসেবে যোগদান করে ২০১১ সালে বিভিন্ন সময়ে ৯১৫০, ৬৯৭৮, ৯৩৫৫, ২৯২২ নং দলিল সম্পাদনের কারণে সরকার প্রায় কয়েক কোটি টাকার রাজস্ব হারায় সরকার। উক্ত ঘটনায় ২০১৬ সালে বনানী থানায় মামলা হলেও মন্ত্রী এমপিদের তদবিরে তিনি অধরা থেকে যান। অনিয়ম দুর্নীতি ডেকে রাখতে মন্ত্রী এমপি আমলাদেরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্চা জানানো ছিল তার কোট-কৌশল।
এসব অনিয়ম দুর্নীতির কান্ডে বরখাস্ত হয়েছেন একাধিকবারে। দুদকের অনসন্ধানে সত্যতা প্রমাণিত হলেও ছিলেন ও আছেন বহাল তবিয়তে। কর্ম জীবনে সরকার দলীয় মন্ত্রী আমলাদের সাথে সক্ষতা ও নাম ভাঙ্গিয়ে আতংক সৃষ্টি করে মোটা অংকের বিনিময়ে দেড় শতাধিক নিয়োগ, পদায়ন, প্রেষণে নিয়োগ, বদলি বাণিজ্য করে হাতিয়ে নিয়েছেন কয়েক কোটি টাকা। সাবেক আইন মন্ত্রী আনিসুল হকের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক থাকায় ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেননি।
সাবিকুন নাহারের পৈত্রিক বাড়ী ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার শাক্তা (পশ্চিম পাড়া) এলাকায়। দাম্পত্য জীবনে জড়িয়েছেন সাবেক আইন মন্ত্রী আনিসুল হকের এলাকা কসবায়। শাক্তা ও কসবায় রয়েছে কোটি টাকার সম্পত্তি। স্বামী, ছেলে সৈয়দ মোঃ সামিন ইয়াসার, মেয়ে সাবাহ ও ইকরাসহ আত্নীয়দের নামে গড়ে তুলেছেন কোটি টাকার সম্পদ। ধানমন্ডি ১০/এ রোডে ৩৭ নং দৃষ্টিনন্দন ও আলোচিত বাড়ি “গোলাপ ভিলা“। ধানমন্ডির ৯/এ রোডে ১৫ কাঠা জমির উপর নির্মাণ করেছেন গোলাপ ভিলা-১ ও গোলাপ ভিলা-২ নামে আট তলা দৃষ্টিনন্দন বাড়ি। রাজধানীর উত্তরা, হাতিরপুল, গুলশানসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে রয়েছে একাধিক প্লট ও ফ্লাটসহ মার্কেট, দোকান, স্বর্ণের ব্যবসা। তিনি সহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের চলাফেরার জন্য রয়েছে আলাদা আলাদ বিলাশ বহুল গাড়ি।
পূর্বে সাবিকুন নাহারের সম্পত্তি নিয়ে দুদক অনুসন্ধান শুরু করে তিনিসহ পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সম্পদের তথ্য উপাত্ত চেয়ে ২০২২ সালের ২৫ জুলাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ ব্যাংক, বিভিন্ন জেলা রেজিস্ট্রি অফিসসহ ২৪টি দপ্তরে চিটি দিয়েও আলোর মুখ দেখতে পারেনি দুদক। স্বৈরাচার শক্তির ছত্র ছায়ায় ছিলেন বহাল তবিয়তে। ছাত্র জনতার গণ-অভ্যূত্থানের পরেও থেমে নেই গাজীপুরে তার অনিয়ম দুর্নীতি। জনমনে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, কে বা কারা আছেন এই দানবীয় কর্মকর্তার পিছনে, তার দ্বারা তাদের সুবিধাই বা কি? নাকি তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। এই প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে নিবন্ধন অধিদপ্তর সহ জেলার সাধারণ মানুষের মাঝে।
পূর্বে দলিলের রকম পরিবর্তন যোগসাজোস ও লেনদেন মধ্যস্ততাকারী হিসেবে কাজ করতেন তার ভাই ইয়ামিন। সংবাদ প্রকাশের পর ভাইকে আড়াল করে সহযোগি হিসেবে বেচে নিয়েছেন ইয়ামিন এর ঘনিষ্ট বন্ধু ইয়ার হোসেন রাকিব। সে সাবিকুন নাহারের আত্নীয় হিসেবে রেজিস্ট্রি ও ভূমি অফিসে পরিচিত। মাদারীপুর জেলায় সিডি খান এলাকার মোঃ আলমগীর সিকদারের পুত্র। ইউনিয়ন যুব লীগ নেতা ও বর্তমানে ইউনিয়ন সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী। বৈষম্য বিরোধী আন্দোলন চলাকালীন প্রকাশ্যে ছাত্র জনতার বিপক্ষে অবস্থান নিতেও দেখা যায়। সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কিছু অসাধু দলিল লেখকদের সাথে সমন্বয় করে রকম পরিবর্তন দলিল সম্পাদনে মধ্যস্ততা ও লেনদেনসহ নামজারি করে দেওয়ার দ্বায়িত্ব পালন করেন। নগরীর গাছা ভূমি অফিসে দালালদের মুল হোতা হিসেবে তার যথেষ্ট প্রভাব পরিচিতিও রয়েছে।
মুজিব নগরের কর্মচারি থেকে সাব-রেজিস্ট্রার জাহাঙ্গীর আলম ও জেলা রেজিস্ট্রারকে নিয়ে একাধিক সংবাদ প্রকাশিত হলেও থেমে নেই গাজীপুরে তাদের রমরমা বাণিজ্যে। জেলার যে কয়টি সাব-রেজিস্ট্রী অফিস রয়েছে তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি রকম পরিবর্তন দলিল সম্পাদন করেছেন টঙ্গী সাব-রেজিস্ট্রার আবু হেনা মোহাম্মদ মোস্তফা এবং তাহার পূর্ববর্তী সাব-রেজিস্ট্রার মোঃ নুরুল আমিন তালুকদার। কোনটাসা করে রাখার জন্য রয়েছে প্রত্যেক সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে কিছু অসাধু দলিল লেখক, জেলা রেজিস্টার কার্যালয়, নকল ও তল্লাশী খানায় অফিস সহকারী, পিয়ন ও বহিরাগতদের সম্বন্নয়ে শক্তিশালী সিন্ডেকেট ও লাটিয়াল বাহিনী।
সাবিকুন নাহারের ঘুষ বাণিজ্য পূর্বের ন্যায় গাজীপুরে চলছে একই নিয়মে। এসব অফিস থেকে সই মহরী নকল বাবদ নেন ৫০০ ও দলিল প্রতি নেন ১২০০ টাকা। জমির শ্রেণি পরিবর্তন দলিলে নেন দুই থেকে অর্ধলক্ষ টাকা। প্রতিমাসে সাব-রেজিস্ট্র অফিসে অডিটের নামে নেন দশ থেকে পনের লক্ষ টাকা। এসব ঘুষ দুর্নীতির একটি অংশ ব্যয় করেন নিবন্ধন অধিদপ্তর হতে আসা অডিটর, সাবেক আইন মন্ত্রীর আশীর্বাদ ও স্বৈরাচার সরকারের সন্তোষ্টি বজার রাখার পাশাপাশি মন্ত্রী এমপিদের উপটোকন প্রদানে। আর কিছুদিন পর এলপিআরে যাবেন তাই তাহার বিরুদ্ধে ঘুষ দুর্নীতির সকল অভিযোগ ধামাচাপা দিয়ে রেখেছেন।
জেলার অন্যান্য সাব-রেজিস্ট্রারগণদের কে চাপে রাখাসহ এ সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রন ও লেনদেনের মধ্যস্থতা হিসেবে বেচে নিয়েছেন গাজীপুর সদর সাব-রেজিস্ট্রার মোঃ জাহাঙ্গীর আলম কে। তিনি এ মাসেই এলপিআরে যাবেন। তাদের এই কর্মকান্ডে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা অপরদিকে সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিবন্ধন অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, সাবিকুন নাহার ঢাকা জেলার ডিআর থাকাকালীন সময়ে হয়ে উঠেছিলেন একছত্র অধিপতি। কোন সাব-রেজিস্টার বা জেলা রেজিস্টার কোথায় বদলি হবেন তা নির্ধারণ করে দিতেন। ডিআর, সদর ও টঙ্গী সাব-রেজিস্ট্রারের ঘুষ দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনে দুইটি করে মামলা রয়েছে। কিছূদিন পূর্বে জনস্বার্থে জেলা রেজিস্টারসহ ১৭ জনের দুর্নীতি অনুসন্ধানে আইন উপদেষ্টা বরাবরে একটি অভিযোগ দেওয়া হয়েছে।